কুমারখালী-খোকসা আসনে বিএনপি প্রার্থী ছিলেন ‘কুখ্যাত রাজাকার’

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত কুখ্যাত রাজাকার নুরুল ইসলাম আনছার প্রামানিককে কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসন থেকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। ৭১’ এর যুদ্ধের সময় আনছার প্রামানিক রাজাকার বাহিনী গঠন করে দোকানপাট লুট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাসহ বিভিন্ন অপকর্মের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিএনপির এই নেতা। বলেন, ‘আমার আকাশ চুম্বি জনপ্রিয়তা দেখে প্রতিপক্ষ এসব গুজব ছড়াচ্ছে। আর আমি আওয়ামী পরিবারের ছেলে।’
এদিকে গত বৃহস্পতিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা তো বলেছি কোনো যুদ্ধাপরাধীকে আমাদের প্রতীক দেব না। কেউ যুদ্ধাপরাধ না কইরা থাকলে তাকে দিতে অসুবিধা কী?’
২০০৯ ও ২০১০ সালে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর এবং কুমারখালী শহরের বাসষ্টান্ডে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে রাজাকারের তালিকা করা হয়। এই তালিকায় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, এরশাদ সরকারের সাবেক খাদ্য প্রতিমন্ত্রী কোরবান আলীর পরেই বিএনপির এই নেতার নাম রয়েছে। এছাড়া কুমারখালী পৌর এলাকার রাজাকারের তালিকায় তার নাম এক নম্বরে।
গত অক্টোবরে কুষ্টিয়ার স্থানীয় একটি পত্রিকার ফিচার পাতায় আনছার প্রামানিককে কুমারখালী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের পৃষ্ঠপোষক বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে কুমারখালী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতি। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় আনছার প্রামানিক কুমারখালী উপজেলায় রাজাকার বাহিনী গঠন করে এবং কুমারখালী বাজারে কালীদাস, কালাদত্ত ও চিত্তশার দোকান লুট করে। এছাড়া যদুবয়রা গোবিন্দপুর গ্রামে গৌড় ঠাকুরের বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন অপকর্মের মূল হোতা ছিল বিএনপির এই নেতা। সে সময় তার বাবা মুনতাস প্রামানিক ও তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
কুমারখালী উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় বিএনপির এই প্রার্থী অনেক বাড়িতে লুটপাট করেছে। বিশেষ করে হিন্দুদের উপর তার পরিবার বেশি নির্যাতন করত। কুমারখালী-খোকসার মাঝামাঝি বেশ কয়েকটি গ্রামে সে লুটপাট চালিয়েছিল। যুদ্ধের পর হঠাৎই সে বিএনপি জামায়াত ছত্রছায়ায় কুমারখালীতে কয়েকবার মেয়র নির্বাচিত হন। এবার আবার বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছে। তবে এই আসন থেকে সে জয়ী হতে পারবে না। কারণ আওয়ামী লীগ থেকে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সে কুমারখালীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান।’

কুমারখালী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির সভাপতি এটিএন আবুল মনছুর মজনু জানান, ‘যুদ্ধ চলাকালীন যদুবয়রার গোবিন্দপুর গ্রামে গৌড় ঠাকুরের বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে একশ মণ গুড় লুটে নেওয়া হয়। এছাড়া হেলালপুর গ্রামের দুই ভাই বীরেন্দ্র নাথ ও ধীরেন্দ্র নাথ নামে দুই ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। তাদের ছোট ভাই হরেন্দ্র নাথ আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করে। সেটা এখনও তদন্তধীন রয়েছে। যুদ্ধের সময় আনছার প্রামানিক কুমারখালী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের কাঙ্গালী পরিবারের সাত সদস্যদের ধরে নিয়ে যায় দুর্গাপুর ক্যাম্পে। সেখানে নিশংস ভাবে হত্যা করে গভীর পানিতে ফেলে দেয়।’
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘৯৬ এর নির্বাচনের পর থেকে আমরা রাজাকার মুক্ত সংসদের দাবিতে আন্দোলন করে আসছি। এবারও নির্বাচনের চার মাস আগেই সভা সেমিনার করে সকল রাজনৈতিক দলকে আহবান করেছি তারা যেন এই ধরণের লোককে মনোনয়ন না দেয়। কিন্তু দুভার্গের বিষয় মনোনয়ন দাখিলে পরে দেখলাম বিএনপি থেকে ২৫ জন জামায়াতি ইসলামী নেতা এবং তার বাইরেও অনেক চিহিৃত রাজাকারকে তারা নমিনেশন দিয়েছে।
তিনি বলেন, এটা দেশ ও জাতির জন্য দুভাগ্যজনক। আর এসব রাজাকারদের মনোনয়ন দিয়ে বিএনপি তাদের পরাজয়কে অনিবার্য করে তুলেছে। রাজাকার যারা মনোনয়ন পেয়েছে আমরা তাদের কে প্রতিহত করব। যেসব আসনে এই রকম কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে সেসব আসনে আমরা পোস্টার করে জনগণকে ভোট দিতে নিষেধ করছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম আনছার প্রামানিক বলেন, ‘এলাকায় আমার অনেক জনপ্রিয়তা। ৭৬ সালে আমি কমিশনার তখন বয়স ছিল ২৩ বছর। আর আমি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। যুদ্ধের সময় আমি মেট্রিক পাস করি। বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর আমি রাস্তায় ছিলাম; প্রতিবাদ করেছি। পরে চারবার মেয়র হয়েছি। যে বারই সংসদ নির্বাচন করতে গেছি সেই বারই প্রতিপক্ষরা আমাকে দমাতে চেয়েছে। আবার আওয়ামী লীগে আমার মূল্যায়ন হয়নি। পরে বিএনপিতে যোগদান করি। এরপর থেকেই আমার নাম আতাত করে ও টাকা পয়সা দিয়ে রাজাকারের তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আমি যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছি। জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত একটি সার্টিফিকেট আমার কাছে আছে। মুক্তিযোদ্ধারা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা অভিযোগ করেছে তারাই তো আসল মুক্তিযোদ্ধা না। এলাকায় খোঁজ নিন সব জানতে পারবেন।’
Social Link